‘গ্যাং কালচারের’ নামে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে কিশোররা। রাজধানীসহ সারাদেশে বাড়ছে এসব কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা। শুধু রাজধানীতেই নয় দেশের বিভাগীয়, জেলা ও থানা শহরের রাস্তা ঘাট ও পাড়া মহল্লায় দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং নামের উঠতি বয়সের স্কুল পড়ুয়া বখাটেরা। যাদের প্রত্যেকের বয়স আঠারো বছরের নিচে। আর অনেক ক্ষেত্রেই এদেরকে আশ্রয় দিয়ে ব্যাবহার করছে ছাত্র ও যুব রাজনীতিবিদরা। এদের নিজ নিজ দলের রয়েছে নানা সাংকেতিক নাম।
বর্তমান সময়ে দেশের প্রায় সব এলাকায় চলছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। এদের তৎপরতা কমাতে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রতিদিনই আটক করা হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, সিনিয়র অপরাধীদের চেয়ে অনেকটাই ভয়ানক হয়ে উঠছে কিশোররা। উঠতি বয়সী এই কিশোর গ্রুপ দেশজুড়ে রয়েছে এবং তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন। সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনার পর এসব কিশোরদের তৎপরতাকে রুখে দিতে মাঠে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুধু রাজধানীতেই আটক করা হয়েছে হাজারের বেশি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে দল তৈরি করা থেকেই এসব গ্রুপের সূচনা হয়। তাছাড়া মহল্লায় আধিপত্য বিস্তার, দল বেঁধে বেড়ানো, মেয়েদের উত্যক্ত করা, ঝুঁকিপূর্ণ বাইক রাইডিং, অনলাইনে প্রতিপক্ষ তৈরি করা, ছিনতাই, চাঁদাবাজির মতো ঘটনা থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত হচ্ছে এদের হাতে।
কিশোর গ্যাংয়ে কিভাবে এলেন আর পরিবার কি জানে কিনা এ বিষয়ে তারা বলে থাকে আমরা সমস্ত উত্তরা জুড়ে রাজত্ব করি, বন্ধুদের মাধ্যমে জড়িয়েছি। আমাদের বড় ভাইদের বিভিন্ন কাজে দল বেঁধে গিয়ে আমরা মারামারি, দখলবাজি করে থাকি। নেতাদের নাম জানতে চাইলে বলেন, নাম প্রকাশ করা যাবে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিরোইজম থেকেই কম বয়সী এসব কিশোররা নানা রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। সমাজের চোখে হিরো হতে চায় ওরা। যার ফলে দলবল নিয়ে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে। আর সেখান থেকেই সাহস সঞ্চয় করে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সন্তান গ্যাংয়ের সদস্য জানতে পারলেই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বরং পারিবারিক কিছু উদ্যোগের মাধ্যমেই তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিশোরদের গ্যাংয়ে জড়িত হওয়া ঠেকাতে অভিভাবকরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ রকম ঘটনায় ছেলে-মেয়েদের টাকার চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে তাদের বাসায় ফেরার সময়সূচিরও ঠিক থাকে না। এই দুটি বিষয় দেখা গেলেই সতর্ক হওয়া উচিৎ। সম্প্রতি কিশোর গ্যাং সদস্যরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাত মসজিদ এলাকায় ছুরিকাঘাতে মহসিন (১৬) নামে এক স্কুলছাত্র স্থানীয় কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যের হাতে খুন হয়। নিহত মহসিন রিমঝিম কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ছিল বলে জানা গেছে।
এদিকে, রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায় দক্ষিণখান থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গাজীপুরে ‘তুই’ করে বলায় চা বিক্রেতা এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে গাজীপুর জেলা শহরের রাজদীঘিরপাড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
গাজীপুর পুলিশ সূত্র জানায়, জেলার রাজদীঘিরপাড় এলাকায় গল্প করার সময় ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে নূর ইসলাম তার চেয়ে বয়সে বড় সাহাপাড়া এলাকার রানা নামের এক বন্ধুকে তুই বলে শাসালে কয়েকজন কিশোর উত্তেজিত হয়ে উঠে। এসময় তাদের মাঝে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে আত্মরক্ষার্থে নূর ইসলাম দিঘীর পানিতে ঝাপ দেয়। পরে নূর ইসলামকে পানি থেকে তুলে এনে কয়েক কিশোর ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়।
কিশোর গ্যাং সম্পর্কে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল অভিভাবক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, কিশোররা সন্ধ্যার পর কেনো বাইরে থাকবে? তারা পড়ার টেবিলে যাবে, সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে আসবে। এদের আমরা লক্ষ্য করছি অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকছে। অনুরোধ করব অভিভাবকদের, আপনার সন্তান কোথায় খোঁজ রাখুন। সন্তান কে কী করছে খেয়াল রাখুন।
কিশোর গ্যাং সম্পর্কে হাতিরঝিল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল ফারুক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পাড়া-মহল্লায় উঠতি বয়সের ছেলেরা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। তারা খুন-খারাপিতেও জড়িয়ে পড়ছে। যৌন হয়রানি এবং মাদকের সঙ্গে অনেকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এদের দমন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, আমি নিজেই কিশোর গ্যাং বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে একদিনে ১৫৩ জনকে আটক করেছিলাম। তবে যাচাই বাচায় শেষে ৮ জনের মত অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পেয়েছি। বাকিদের অভিবাবকের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীর হত্যার মধ্য দিয়ে পরিচিতি পায় কিশোর গ্যাং বিষয়টি। আদনান হত্যার পরেও ঘটে বেশ কয়েকটি অনাকাঙ্খিত হত্যার ঘটনা।